প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় বিধ্বস্ত ইতালি। দেশটিতে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। চীনের পরে সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ইতালিতে। আর মৃত্যুর সংখ্যায়ও সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। ইতালির শহরগুলিতে শুধু লাশ আর লাশ। হাসপাতালগুলিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। চীনে উৎপত্তি হলেও ইউরোপের দেশ ইতালিতে কীভাবে ভাইরাসটি এত ব্যাপকভাবে ছড়ালো সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সবাই মরিয়া। এবার ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফুটবল মাঠ থেকেই ইতালিতে ছড়িয়েছে ভাইরাসটি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মিলানের বিখ্যাত সানসিরো স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউট পর্বের প্রথম লেগে আটালান্টার মুখোমুখি হয়েছিল স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া। সেদিন সানসিরোর গ্যালারিতে হাজির ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার দর্শক। ওই ম্যাচের পরই নাকি ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। সে ম্যাচে ৪-১ গোলে জয়লাভ করে ইতালির ক্লাব আটলান্টা। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসরের প্রথম লেগে স্পেনের শক্তিশালী ক্লাব ভ্যালেন্সিয়াকে হারানোয় উৎসবে মেতে ওঠেন খেলোয়াড় ও দর্শকরা। সেখান থেকেই ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস!
করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লম্বার্দি অঞ্চলের বার্গামোইতে আটালান্টা ক্লাব অবস্থিত। তাই সেদিন গ্যালারিতে থাকা দর্শকের অধিকাংশই ছিল বার্গামো থেকে আসা। পরে দেখা যায়, এই বার্গামোই সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত। ওই ম্যাচ দেখতে আসা দর্শকদের অনেকে কয়েক দিনের মধ্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষায় পজিটিভ ধরা পড়ে। ভ্যালেন্সিয়ার পঁয়ত্রিশ শতাংশ ফুটবলার ও কর্মকর্তা আক্রান্ত হওয়ার পেছনেও এ ম্যাচকেই দেখছেন অনেকে। সেদিন মাঠে উপস্থিত ছিলেন স্পেনের অনেক দর্শকও। তাই স্পেনে করোনা সংক্রমণের পেছনেও ওই ম্যাচকেই অনেকে দায়ী করছেন।
বার্গামোর মেয়র জর্জিও গোরি বলেছিলেন, ‘এটি পরিষ্কার যে সেদিন সন্ধ্যায় যে বিজয় উৎসব হয়েছিল সেখান থেকেই ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।’
এছাড়া মেয়রের অভিযোগ, তার শহরের দুর্দশার সবচেয়ে বড় একক উৎস হলো সম্ভবত সেই অঞ্চলের একটি হাসপাতাল যেখানে কোনো রোগীকে করোনভাইরাস শনাক্ত না করেই ভর্তি করা হয়েছিল এবং সেটা অন্যদের সংক্রমিত করতে সাহায্য করেছিল। যাই হোক, ফুটবল ম্যাচটি একটি কারণ হতে পারে, বিশেষত যখন খেলা হয় তখন সামাজিক দূরত্বের বিষয়টা জরুরিভাবে দেখা সম্ভব হয় না।
এ সময় ইতালিতে খুব কম লোকই কোভিড-১৯ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ম্যাচটি খেলার দুই দিন পরে দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর দু’সপ্তাহের মধ্যে বার্গামো ও তার আশেপাশের এলাকায় মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে করোনভাইরাস।
সেখানে প্রাদুর্ভাবের অস্বাভাবিক প্রকৃতি সম্পর্কে, একজন ইতালীয় ইমিউনোলজিস্ট বার্গামোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস এবং বাসিন্দাদের কঠোর পরিশ্রমী মানসিকতাকে দায়ী করেছেন। অসুস্থতার লক্ষণগুলি এড়িয়ে তার নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চালিয়ে গেছেন, ফলে করোনা মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ফ্রান্সেস্কো লে ফোচেও নামের ওই ইমিউনোলজিস্ট করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য সানসিরোর ওই ফুটবল ম্যাচকেও দায়ী করেন। ফুটবল মাঠ থেকেই ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মাঝে করোনা ছড়িয়ে পড়েছিল বলে অভিমত তার।
সানসিরোর ওই ম্যাচের ইতালির বেশকিছু ফুটবলারও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ইতালির কিংবদন্তি ফুটবলার পাওলো মালদিনি। তার ছেলে ড্যানিয়েল মালদিনিও আক্রান্ত। দুই মালদিনির আক্রান্তের কয়েক ঘণ্টা আগেই জুভেন্তাসে তৃতীয় ফুটবলার হিসেবে আর্জেন্টিনার পাওলো দিবালা এবং তার বান্ধবী ওরিয়ানা সাবাতানির করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে। এ ছাড়া সাম্পদোরিয়ার পাঁচজন, ফিওরেন্টিনার দু’জনও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। স্থগিত হওয়ার আগে এ মাসের ৮ ও ৯ তারিখ সিরি ‘এ’ সর্বশেষ রাউন্ড হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, তখনই ফুটবলারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে করোনা।
ইতালিতে করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ৫০৩ জন। আক্রান্ত হয়েছে ৭৪ হাজার ৩৮৬ জন। চীনের ৮১ হাজার ২৮৫ জনের পরে ইতালিতেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা। আর মৃত্যুর সংখ্যায় চীনকে অনেক আগেই টপকে গেছে ইতালি। দেশটির সরকার কোনোভাবেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।